::: নাদিরা শিমু :::
নাম পরিচয় এক হলেও ভিন্ন ভিন্ন জন্ম তারিখ ব্যবহার করে একের পর এক বিয়ে করে আজব বাণিজ্য করে চলেছেন চট্টগ্রামের এক নারী। সম্প্রতি চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার বরাবর ভুক্তভোগী রেহানা আক্তার রুমার প্রেরিত এক অভিযোগে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে।
অভিযোগে তথ্যমতে, প্রতিটি কাবিননামায় নিজেকে কুমারী সাজিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে করেছেন একের পর প্রতারণার বিয়ে । শুধু তাই নয়, চতুর এই মহিলা প্রতারণার মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে করেছেন অর্থ-সম্পদ লুট। বিত্তশালী, প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে প্রেমের অভিনয় করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে ।
চট্টগ্রামের নগরীর বেটারীগলির বাসিন্দা সিনথিয়া আক্তার মুনার বিরুদ্ধে উঠা এসব অভিযোগের সত্যতা জানতে মাঠে নেমে পাওয়া যায় চাঞ্চলকর সব তথ্য, এ যেন মানুষকে গর্তে ফেলে টাকা কামানোর এক অবৈধ পন্থা।
মূলত নগরীর স্বনামধন্য ব্যবসায়ীদেরকে টার্গেট করে প্রেমের জালে ফেলে কৌশলে বিয়ে করে নেয় সিনথিয়া আক্তার মুনা। এরপর ২-৩ মাস সংসার করার পর কাবিনের টাকা আদায় করে তাকে বিভিন্ন হুমকি-দামকি দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে রাখে। এই কাজগুলো শুধু মুনা একাই করেন না, তার সাথে কাজ করে শক্তিশালী একটি চক্র। যে চক্রের মূল হোতা সিনথিয়া আক্তার মুনা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালে ১৭ জুলাই নগরীর পাটানটুলির বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন খান সজিবের সাথে পাঁচ লাখ টাকার কাবিনে কুমারি হিসেবে বিয়ে হয় মুনার সাথে। এই বিষয়ে মোশাররফের সাথে কথা বলে জানা যায় তার টাকা পয়সা দেখে কৌশলে প্রেমের জালি ফাঁসিয়ে তাকে বিয়ে করে নেয় মুনা। কিন্তু বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। অফিসিয়াল কোনো তালাকনামা না করে এক প্রকার সমঝোতার মাধ্যমে মোশাররফ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয় তাকে। এসব কথা কারো সাথে যেন শেয়ার না করে সেজন্য মুনা দেখিয়েছেন বিভিন্ন ভয়ভীতি। যার কারনে মুখ খুলতে সাহস করেননি মোশাররফ।
এরপর নতুন প্রতারণার জাল বুনতে থাকেন মুনা। তার প্রেমের জালে ফাঁসাতে এবারে বেছে নিয়েছেন লালখান বাজারের পশ্চিম বাঘগোনার বাসিন্দা নাছির হোসেনকে। ২০১১ সালের পহেলা জুলাই দ্বিতায়বারের মত পাঁচ লাখ টাকা কাবিনে কুমারি সেজে নাছিরের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন মুনা। এই বিষয়ে নাছিরের সাথে কথা বলে জানা যায়, মুনা তার পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কথা শেয়ার করতো তার সাথে। এরপর ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্ক তৈরী করে বিয়ে করে নেয় মুনা। কিন্তু বিয়ের সময় মুনার জন্ম তারিখ লেখা হয় ১৯৯২ সালের ৬ জুন, যা ছিলো সম্পূর্ণ ভুয়া। এছাড়া বিয়ের কাবিনে দেখা যায়, তালাক কার্যকর না করেই তার থেকে লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এভাবেই একের পর এক লাগামহীনভাবে প্রতারণা করে আসছে মুনা।
সিনথিয়া আক্তারের সাম্প্রতিক শিকার চট্টগ্রাম নগরীর আরেক বর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী হালিশহরের শহীদুল ইসলাম। শহীদুলের টাকা দেখে তাকে ছলে বলে কৌশলে প্রেমের অভিনয় করে ফাঁসিয়েছেন। ভুক্তভোগী শহীদুলের সাথে কথা বলার পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুনা এবং তার সাঙ্গ পাঙ্গোদের নিয়ে জোরপূর্বক নগরীর এশিয়ান এসআর হোটেলে ৪ লাখ টাকা কাবিনে কুমারি হিসেবে তৃতীয় বারের মতন বিয়ের পিঁড়িতে বসেন মুনা।
শহিদুল জানান, বিয়ের পর বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় মুনা এবং তার চক্রটি। জানা গেছে এর আগে যে দুজনের সাথে বিয়ে হয়েছে তাদের থেকেও বিয়ের পর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় বিয়েকে পুঁজি করে ব্যবসা করা এই নারী।
মুনার জালে আরেক শিকার চট্টগ্রামের আরেক বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী মোঃ মঈনুদ্দিন। এবারের গল্পটি বেশ চমৎকার। মঈনুদ্দিনকেও তার জালে ফাঁসানোর জন্য অবলম্বন করেন ভিন্ন এক পন্থা। এ যেন বাংলা সিনেমার কাহিনী। প্রথমত মঈনুদ্দিনের কোম্পনিতে চাকুরি নেয় মুনা। এরপর বিভিন্ন কৌশলে তার অফিসের বস অর্থাৎ মঈনুদ্দিনকে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে মুনা। এরপর একের পর এক ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে মুনা। এক পর্যায়ে তাকে ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর ২০ লাখ টাকা কাবিনে পূর্বের মতন কুমারি সেজে জোরপূর্বক বিবাহ করেন মঈনুদ্দিনকে।
ভুক্তভোগী মঈনুদ্দিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই বিয়ে বাণিজ্যের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে আরো কয়েকজন, যাদের মধ্যে অন্যতম হলো চট্টগ্রামের অনিবন্ধিত একটি অনলাইন চ্যানেলের মালিক । অভিযোগ রয়েছে অনলাইন চ্যানেলের এই মালিক এভাবেই অবৈধভাবে নারীদের দিয়ে বছরের পর বছর ব্যবসা করাচ্ছেন তিনি। এছাড়া দাফট খাটিয়ে মানুষের থেকে টাকা ও ভুমি দখল করারও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
মঈনুদ্দিনের সাথে বিয়ের কাবিনেও ভুল লিখা হয় জন্ম তারিখ। কাবিন নামা দেখে জানা যায় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৯৭ সালর ৫ জুন। একেকবার একেক জন্ম তারিখ দিয়ে বিয়ে করেন মুনা। এরপর মঈনুদ্দিন থেকে নামে বেনামে হাতিয়ে নিয়ছেন আরো ৭০ লাখ টাকা। পরিশেষে ১১ মাসের ব্যবধানে কাবিনের টাকা নিয়ে তাকেও ছেড়ে দেয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কাউকেই অফিসিয়ালী ভাবে তালাক দেয়নি মুনা। এভাবেই একের পর বিয়ে করে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। পরপর ছয়টি বিয়ে করেও ক্ষান্ত হননি, বিয়ে নিয়ে ব্যবসা করা এই নারী। এরপরেও নামে বেনামে বিয়ে করেছেন আরো অনেক।
জানা গেছে, এসব কিছুর পিছনে রয়েছে তারই পিতা আব্দুল করিম এবং তার আপন ভাই। মেয়েকে দিয়েকে এভাবেই ব্যবসায়ীদের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে বছরের পর বছর এখন পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা।
এতো অভিযোগ যার বিরুদ্ধে তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, এসব অভিযোগের সত্যতা নেই। ষড়যন্ত্রকারীরা এসব তথ্য ছড়াচ্ছে। পুলিশ কমিশনারের কাছে অভিযোগের বিষয়ে কিছু জানা নেই দাবি মুনার।