18 C
Dhaka
Sunday, February 16, 2025
More

    ‘ঘটনা সত্য সাক্ষী দুর্বল’ নাটকে পার পাবেন কর্ণফুলী গ্যাসের ‘দুর্নীতিবাজ’ চক্র

    আরও পড়ুন

    ::: নেওয়াজ তুহিন :::

    চট্টগ্রামের হালিশহরে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেবার কারনে দুদকের মামলায় আসামী করার পর আলোচনায় আসেন সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে মুজিবুর রহমান। এভাবে অবৈধ  কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নজিরবিহীন অনিয়ম দূর্নীতি দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে। অভিযান চালিয়ে ২০২১ সালে ১২ ই জুন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রকৌশল বিভাগের লোকজন নগরের চান্দগাঁও থানার সানোয়ারা আবাসিক এলাকার মুজিবুর রহমানের নেয়া ২২টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।

    কিন্তু দেড় পর পরে এসে দুদকের দ্বিতীয় দফা তদন্তে সাক্ষীর অভাবে অভিযোগ প্রমাণ হয় নি বলে চুড়ান্ত  প্রতিবেদন দেবার অনুমোদন নিয়েছেন  নতুন তদন্ত কর্মকর্তা,  দূর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয় -২ এর উপ পরিচালক আতিকুল আলম। নথি অনুযায়ী গত বছরের ৩১ শে অক্টোবর এই মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন (FRT) দাখিলের অনুমতি চান তিনি। সাবেক মন্ত্রীপুত্রসহ পাঁচজনকে অব্যাহতি দিয়ে সেই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবার অনুমোদন দিয়েছে দুদক। দুদকের সেই চিঠি বুধবার চট্টগ্রামের আদালতে পৌঁছের।

    আইন বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্যমতে  Final report true  বা এইফআরটি হলো কোন মামলার চুড়ান্ত  প্রতিবেদন দেবার পাঁচটি পদ্ধতির একটি। সহজ কথায় সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে রুজু করা কোন মামলা সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে প্রমাণ করা না গেলেই এমন প্রতিবেদন দাখিল করা হয় আদালতে। এমন ক্ষেত্রে  আদালত এজাহারকে চুড়ান্ত ধরে নিয়ে মামলার রায় দেবার নজির রয়েছে।

    খোঁজ নিয়ে জানা যায় গেল বছরের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন এই মামলার আসামীদের দুজন। বিচারাধীন মামলার আসামীদের সংবাদ সম্মেলন করা নিয়ে দুদকের নিরব ভূমিকায় স্পষ্ট হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা আতিকুল আলমের ‘এফআরটি’ অনুমোদন চেয়ে প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেবার সময় বিশ্লেষণ করে। অক্টোবরের শেষ দিনে এফআরটির অনুমোদন চাওয়া হয়, আর সপ্তাহের ব্যবধানে সংবাদ সম্মেলন করেন একই মামলার আসামী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন তদন্তকারী  দুদক কর্মকর্তার সাথে আসামীদের সাথে  নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে -সেটি সেই সংবাদ সম্মেলন থেকেই অনুমান করা যায়।

    দুদকের নথি অনুযায়ী  ৯ ই ফেব্রুয়ারী মামলাটির চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেবার অনুমোদন  দেয়া হয়েছে। দুদকের কমিশনার (তদন্ত)  জহিরুল হক  স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে,

    তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত সাক্ষ্য স্মারক ও অন্যান্য রেকর্ডপত্র পর্যালেচনা করিয়া উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ায় কমিশন কর্তৃক পরিতুষ্ট হইয়া দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ৩২ ধারা এবং দূর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭ এর বিধি ১৫, উপবিধি ১ এ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সুত্রস্থ মামলাটিতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য ( FRT) দাখিলের অনুমোদন sanction জ্ঞাপন করা হইল।

    দুদকের কমিশনার (তদন্ত)  জহিরুল হক  স্বাক্ষরিত চিঠিতে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের এই মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনার দেবার বিষয়টিকে মামলার আসামীদের পরিকল্পিতভাবে বাঁচিয়ে দেবার ‘দুরভিসন্ধি ‘ বলে আখ্যায়িত করেছেন সুশাসন নিয়ে তৎপর বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা।

    দুদকের এই মামলার ( মামলা-৮,১০ই জুন ২০২১) তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সাবেক মন্ত্রীপুত্র মুজিবুর রহমানের অবৈধভাবে নেয়া ২২ টি গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা জানিয়ে বলেছিলেন ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড জালিয়াতির মাধ্যমে আরেকজনের নামে বরাদ্দকৃত ১২টি চুলার গ্যাস সংযোগ ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বন্ধ থাকার পরও আরও ১০টিসহ মোট ২২টি চুলার গ্যাস সংযোগ দিয়েছিল মুজিবুর রহমানকে। বিষয়টি দুদকের তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় মামলার ( চট্টগ্রাম -১,মামলা-৮) আসামি করা হয়  সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমানকে।  একই বছর কর্ণফুলী গ্যাসের জিএমসহ তিনজন গ্রেপ্তারও করা হয়। অভিযোগের বিষয়ে তথ্য প্রমাণ পেয়েই মামলা করা হয়েছিলো।

    এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার পেছনে সংশ্লিষ্ট  রাজনৈতিক বলয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অবৈধভাবে নেয়া গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং কর্ণফুলী গ্যাসের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করার পর সাক্ষ্য প্রমানের অভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয় নি মর্মে প্রতিবেদন দেয়া দূর্নীতির লালন হিসেবে দেখছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব দেখালেও মামলার তিন আসামি গ্রেফতার হবার পর প্রায় চারমাস কারাগারে ছিলেন। চার মাস পর হাইকোর্ট তাদের জামিন দেন। এছাড়া অভিযোগের সত্যতা এবং মামলার কারণে রাইটার মুজিব অদ্যাবধি চাকুরিতে যোগ দিতেন পারেন নি।

    সচেতন  নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আকতার উল কবির মনে করেন, ‘ একই সময়ে এই মামলার  আসামীদের সংবাদ সম্মেলন করা এবং তদন্ত কর্মকর্তার এফআরটির অনুমোদন চাওয়া – সবকিছু একই দূর্নীতির বৃত্তে বন্দী। গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে ;  মানুষ দেখেনি?  সাক্ষ্য প্রমাণ নেই মর্মে প্রতিবেদন দেবার অনুমোদন চাওয়া মানে কি ; সেটি সহজেই অনুমেয়। তথ্য প্রমাণ না পেলে আগে দুদক মামলা করার অনুমতি কিভাবে দিয়েছিলো! ‘

    জানা যায়,  চট্টগ্রামের হালিশহরের বাসিন্দা প্রয়াত এম এ সালামের নামে বরাদ্দকৃত ১৮টি অব্যবহৃত দ্বৈত চুলার মধ্যে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ১২টি দ্বৈত চুলা চান্দগাঁও সানোয়ারা আবাসিক এলাকার মুজিবুর রহমানের নামে স্থানান্তর করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কতিপয় কর্মকর্তারা। তাদের এ অনিয়মকে বৈধতা দিয়ে বানানো হয় মূল গ্রাহক মৃত সালামের স্ত্রী নুরজাহানের নামে ভুয়া চুক্তিনামা। ফলে ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকলেও এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে সানোয়ারা আবাসিক এলাকার মজিবুর রহমানের নামে ওই ১২ টির সাথে অবৈধভাবে আরও ১০ টিসহ মোট ২২টি গ্যাস সংযোগ দেয় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)।

    দুদকের অনুসন্ধানে এমন দুর্নীতির প্রমাণ মেলায় দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এর উপ-সহকারি পরিচালক শরীফ উদ্দিন ( বর্তমানে চাকুরীচ্যুত)  বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। দুদকের মামলার জালে আটকা পড়েন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলম এবং গ্রাহক মো. মুজিবুর রহমান। এদের মধ্যে থেকে প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে  গ্রেপ্তারও করেছিল দুদক।

    শরীফ উদ্দিনের করা মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারি আদেশে আবাসিক খাতে নতুন ও বর্ধিত চুলায় গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। সেই সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে আসামিরা একে অপরের যোগসাজসে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাধমূলক অসদাচরণের মাধ্যমে নুরজাহান বেগম নামে হালিশহরের এক আবাসিক গ্রাহকের ১২টি দ্বৈত চুলা ভিন্ন খতিয়ান ও দলিলের মালিকাধীন জায়গায় চান্দগাঁওয়ের আবাসিক ভবনে স্থানান্তর করেন। যদিও খাতে গ্যাস বিপনণ নিয়মাবলী-২০১৪ এর ৯, ৩ এ হস্তান্তর/স্থানান্তর/একত্রীকরণ প্রসঙ্গে বলা আছে, কোন গ্রাহকের জন্য বরাদ্দকৃত শুধুমাত্র গ্যাস লোড অন্য কোন গ্রাহকের কাছে হস্তান্তর কিংবা বিক্রি করা যাবে না, যৌক্তিক কোনো কারণে গ্যাস সংযোগ স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে মালিকানা অপরিবর্তিত রেখে প্রস্তাবিত স্থানে গ্যাস সংযোগ করা যাবে। আবার কোন গ্রাহক যদি স্থায়ীভাবে সংযোগ বন্ধ করার ঘোষণা দিলে গ্যাস লোড বিতরণ কোম্পানীর কাছে সমর্পিত করতে হবে। অথচ অভিযুক্তরা মূল মালিক না হওয়া স্বত্তেও আলাদা রাইজারের মাধ্যমে খতিয়ান ও দলিলের জায়গার অন্য মালিককে ২২টি গ্যাস সংযোগ প্রদান করে।

    এজাহারে ঘটনার সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয় মৃত এম এ সালাম নামে একজন গ্রাহক তার বাড়ির আঙিনায় স্থাপিত ১৮টি দ্বৈত চুলার মধ্যে ৬টি দ্বৈত চুলা রেখে ১২টি দ্বৈত চুলা চান্দগাঁওয়ের সানোয়ার আবাসিক এলাকায় স্থানান্তরের আবেদন করেন। ২০১৬ সালের অক্টোবরের ২৫ তারিখ আবাসিক খাতে স্থানান্তরে নিরুৎসাহিত করুন মর্মে আবেদনটি কেজিডিসিএলের তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়-দক্ষিণ) প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন আবেদনটি ফিরিয়ে দেন। পরে মৃত এম এ সালাম নামে ওই গ্রাহকের স্ত্রী নুরজাহান সালামের নাম ব্যবহার করে তৎকালীন ডিজিএম মো. সারওয়ার হোসেন ভুয়া আবেদনপত্র ও দলিল সৃজন করে একে অপরের যোগসাজসে জাল দলিল সৃজন করে তথ্য জরিপকারী মো. দিদারুল আলম জরিপ করে স্থানান্তরের সুপারিশ করে। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিজিএমের অবৈধ নির্দেশনায় তার নিচের কর্মকর্তাগণ মো. মুজিবুর রহমানের নামে স্থানান্তরের জন্য অনুমোদন করেন। অন্যদিকে  উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়-উত্তর) চাহিদাপত্র প্রদানের অনুমতি দেন।

    এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দুদক কর্মকর্তা আতিকুল আলম কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি। মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া পাঁচজন হলেন সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সাবেক মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং ও সার্ভিসেস) মো. সারওয়ার হোসেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত দক্ষিণ জোনের টেকনিশিয়ান (সার্ভেয়ার) মো. দিদারুল আলম, সাবেক মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ও ব্যবস্থাপক মজিবুর রহমান।

    জানা যায়, মামলার আসামি সাবেক মন্ত্রীপুত্র  মুজিবুর রহমানের নিকটাত্মীয়  একটি শিল্পগ্রুপের মালিকানাধীন  বেসরকারি টেলিভিশন ও জাতীয় দৈনিকে চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা, মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা  শরিফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে – মামলার এফআরটির অনুমোদন দেয়াকালীন সময়ে। চট্টগ্রামে কর্মরত একাধিক গণমাধ্যমকর্মী জানান,  অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু তিনমাস আগেই চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বিরুদ্ধে করা মামলার আসামিদের সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থাপন করা হয়েছিলো৷ অভিযোগের সত্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবার পরও সাক্ষ্য প্রমাণের অজুহাত দেখিয়ে  এফআরটির অনুমোদন চাওয়া, দুদকের অনুমোদন দেয়া এবং সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের সংবাদ প্রচার একই সুতোয় বাঁধা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর