আল আমিন,নাটোর প্রতিনিধি:-
তঞ্চঙ্গা মূলত চাকমা ভাষারই উপভাষা। অনুরূপ রাখাইন মারমা ভাষার, লালং বা পাত্র গারো ভাষার এবং বিষ্ণুপ্রিয়ামনিপুরী, হাজং বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাষার সংখ্যা হচ্ছে ২৬টি। কোথাও কোথাও ৩৭টি ভাষার নাম উলেখ করা হয়েছে। আসামিজ, বার্মিজ, চিটাগানিয়ান, হাকা-চীন, রিয়াঙ-এর মতোই প্রাচীন একটি ভাষা ‘ সাদরী’। সময়ের সাথে এসব আদিবাসীর ভাষা বিলুপ্তির পথে।
নাটোর সদর উপজেলার দরাপপুর গ্রামের সাথী পাহান ও দীঘি মুন্ডা মাতৃভাষা ‘সাদরি’ ভাষায় একে অপরের সাথে কথা বলছিল। কিন্তু তারা ‘সাদরী’ ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না। কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করেই লজ্জ্বামিশ্রিত হাসি ফুঠে ওঠে তাদের চোখে-মুখে। মাতৃভাষা পুরোপুরি না জানার কারণে কথা বলতে গিয়ে থেমে যেতে হচ্ছিল তাদের। মাতৃভাষা বলতে গিয়ে বারবার বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ উচ্চারণ করছিল তারা। আদিবাসী পরিবার গুলোতে বর্তমানে বাংলা ভাষার প্রভাব বেড়েছে।
‘ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস -পৃথিবীর সকল জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করে। নাটোরের এমনই এক ভাষা ‘সাদরি’। চর্চার অভাবে বিলুপ্তির পথে এই আদি ভাষা।
ছোট বেলা থেকেই পারিবারিক মন্ডলে মা-বাবার কাছ থেকে মাতৃভাষা না শেখার কারণে আজ তাদের এই অবস্থা। শুধু সাথী আর দিঘী নয়, বরং নাটোর জেলায় বসবাসরত অধিকাংশ আদিবাসী শিশুদের ক্ষেত্রে একই অবস্থা দৃশ্যমান। আদিবাসী শিশুরা চর্চার অভাবে ভুলতে বসেছে তাদের মাতৃভাষা। সরকারি-বেসরকারিভাবেও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নাটোর জেলার নাটোর সদর, সিংড়া, গুরুদাসপুর, নলডাঙ্গাসহ ৭টি উপজেলায় ২০-২৫ হাজার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মুন্ডা, পাহান, সাঁওতাল, উঁরাও, মাহাতো, গঞ্জু (সিং), লোহার, রবিদাস ইত্যাদি ১০/১২টি ভাষাভাষী সম্প্রদায়। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা ভাষা থাকলেও চর্চা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে এসব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। বর্তমানে এসব পরিবারে বাবা-মাসহ বয়োজেষ্ঠ্যরা নিজেদের মধ্যে নিজ ভাষায় কথা বললেও শিশুরা প্রমিত বাংলা ভাষার প্রভাবে নিমজ্জিত। শিশুরা মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারে না বললেই চলে। বাবা মায়েরা সন্তানদের সাথে বেশিরভাগ সময়ই বাংলা ভাষায় কথা বলছেন। সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তুক আকারে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পদক্ষেপ নিলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গভাবে সেটার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।
সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তুক আকারে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পদক্ষেপ নিলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গভাবে সেটার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।
গত বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী ভাষায় বই দেওয়া হলেও চলতি বছর এসব ভাষার বই দেওয়া হয়নি।২০১০ সালে দেশের আদিবাসী তথা সরকারি ভাষায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ণ করা হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের শুরুতেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ তৈরী করে।
গত বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী ভাষায় বই দেওয়া হলেও চলতি বছর এসব ভাষার বই দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে গঠিত একটি জাতীয় কমিটি প্রাথমিকভাবে চাকমা, মারমা, ককবোরক, মান্দি, সাঁওতালি ও সাদরি ভাষায় পাঠ্যপুস্তুক তৈরী করে। নাটোর জেলায় সাঁওতালি ও সাদরি ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু শিক্ষক সংকটসহ নানা কারণে সেই কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, যেহেতু ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে মাতৃভাষা শেখার সুযোগ কম পাচ্ছে এবং বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতে এই ভাষা শেখানোর সুযোগ তৈরী না হওয়ায় শিক্ষার্থী মাতৃভাষা শিখতে পারছেনা।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পমী রায় জানান, বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষকরা আদিবাসী ভাষা না জানার কারণে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করতে পারেননা।
অভিভাবকরা জানান, বড়’রা মাতৃভাষায় কথা বললে শিশুরা এসব ভাষার অনেক অর্থই বোঝে না। বিদ্যালয়ে আদিবাসী ভাষার শিক্ষক থাকলে শিশুরা এসব ভাষা চর্চা ধরে রাখতে পারত।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নাটোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কালিদাস রায় জানান, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমন্ডলেই শিশুরা মাতৃভাষা শিক্ষা থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। মা-বাবারা ছোটবেলা থেকেই শিশুদের বাংলা ভাষা শেখাচ্ছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষক সমস্যার কারণে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করতে পারছেনা শিক্ষার্থীরা । সমস্যা উত্তরণে পরিবার ও সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার বিকল্প নেই।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ গোলাম নবী জানান, সাদরি ভাষার বই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু সাঁওতালি ভাষার বই আসেনি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নাদিম সারওয়ার জানান, মাতৃভাষা রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃভাষা রক্ষায় শিক্ষক স্বল্পতা, প্রশিক্ষণ, নিরসনসহ লজিষ্টিক সাপোর্ট যা প্রয়োজন সেগুলো বাস্তবায়নে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। মার্তভাষা রক্ষায় সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি তার সাথে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমরা বদ্ধপরিকর।
এইবা/মামুন