20 C
Dhaka
Friday, February 14, 2025
More

    দেশে মানবাধিকার ও গনতন্ত্রের প্রশ্নে বহির্বিশ্বের চাপ বাড়ছে

    আরও পড়ুন

    ওয়াহিদ জামান ||

    সপ্তাহ জুড়ে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ডামাডোলে আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের সাথে  বিদেশি কূটনীতিকদের আলোচনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও গুরুত্বের ফর্দে নজর এড়িয়েছে আগামী নির্বাচনে গ্রহনযোগ্য কৌশল।  কুটনৈতিক সুত্রমতে, কূটনীতিক তৎপরতার ছায়ায় সরকার ও বিরোধী  রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পর্দার আড়ালে আগামী নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। আগামী জাতীয়  নির্বাচন নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও স্বচ্ছ  কৌশল  খুঁজতে দুই প্রধান দলের সাথে আলোচনা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফর, সামনের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের বার্তা সেই সমঝোতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

    গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গ্রহনযোগ্য  জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নানামুখী তৎপরতা এবং মন্তব্যে সরকার কিছুটা ‘অস্বস্তিতে’ পড়লেও  সরকার সেটি স্বীকার করছে না। অন্যদিকে, সরকারের  বিরোধী দলগুলো দেখাতে চায় নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ইস্যুতে  বিভিন্ন দেশ তাদের পক্ষে আছে।

    ডিসেম্বর মাসের সাত তারিখ থেকে দশ তারিখের মধ্যে যা ঘটেছে সেগুলো ঢাকাস্থ বিদেশি দূতাবাসগুলোকে জানিয়েছে সরকার।

    ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গেল মঙ্গলবার বাংলাদেশ সফরে এসে জাতীয় নির্বাচনের পদ্ধতিগত সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করেছেন । নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে  সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোত্রার। কাছাকাছি সময়ে ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলও উড়ে এসেছিলেন ঢাকায়।বিনয় কোত্রা ও ডেরেক শোলের গেল বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতও শেষ করেছেন । এ ছাড়া সফরকালে তাঁরা একাধিক আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সাথেও।

    সুত্রমতে, সরকারের পক্ষ থেকে প্রেসনোটে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মুল বিষয় হিসেবে  ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ‘ ইস্যু এড়িয়ে গেলেও – কূটনীতিক তৎপরতা মুল বিষয় ‘ গণতন্ত্র,  মানবাধিকার ও নির্বাচন’ – জানাচ্ছেন একাধিক কূটনীতিক সুত্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি জে ব্লিঙ্কেনের উপদেষ্টা ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে আগামী নির্বাচন নিয়ে সতর্কবার্তাও দিয়েছেন কৌশলী ভাষায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র দুর্বল হলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সীমিত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি জে ব্লিঙ্কেনের উপদেষ্টা ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে। ঢাকা সফর করে যাওয়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ দূত শোলে খোলাসা করেই বলেছেন, পৃথিবীর  কোথাও গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়লে, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার সুযোগও সীমিত হয়ে যায়। তবে এর মানে এই নয় যে আমরা সহযোগিতা করবো না, আমাদের সম্পর্ক অর্থবহ হবে না। কিন্তু ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিসর ছোট হয়ে আসবে।

    মাসের শুরুতে এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দুই প্রতিনিধি। ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে। আর অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে আসেন ১৪ ফেব্রুয়ারি। এর আগে জানুয়ারি মাসে ঢাকা সফর শেষ করেছেন   যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ১৫ জানুয়ারি তিনি সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর সপ্তাহখানেক আগে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, নিরাপত্তা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে  আলোচনা করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সিনিয়র ডিরেক্টর ফর সাউথ এশিয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লুবাচার। বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র- দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি প্রতিনিধিদের ঢাকা সফরে গুরুত্ব পেয়েছে  গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা  , মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, রোহিঙ্গা সংকট, গ্রহনযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু বহির্বিশ্বের প্রতিনিধিদের এতো দৌড়ঝাঁপের পরও সরকারের তরফ থেকে নির্বাচন পদ্ধতিতে  ছাড় দেবার কোন ইঙ্গিত মিলেনি।

    বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের  দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে মানবাধিকারের প্রশ্নে দুরত্ব তৈরি হয়েছে , তা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুরো একটি বাহিনী, র‍্যাব ও কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকেই এমন দুরত্বের উৎস বলে বলছেন রাজনীতি ও কূটনীতিক বিশ্লেষকরা। সামনের জাতীয় নির্বাচনের ধরনের সাথে বহির্বিশ্ব ও বাংলাদেশের ‘সম্পর্কের ভবিষ্যত জড়িয়ে পড়েছে।

    রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন মনে করেন,একানব্বই সালে স্বৈরাচারের পতন শেষে গণতন্ত্র ফিরে এলেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শক্তিশালী করা হয়নি। ফলে সংকট যেমন অনিবার্য হয়ে ওঠে তেমনি সংকটের ফাঁক ধরে দেশের রাজনীতিতে বিদেশীদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি হয়। আর আমাদের দলগুলো নিজেরাই এ সুযোগ তৈরি করে দেয়। এছাড়া দাতাদেশগুলোর কেউ কেউ বেশি সহায়তা দেয় ; তাই রাজনৈতিক ও আভ্যন্তরীণ  কোনো ইস্যুতে কথা বলার সুযোগও সেজন্য তারা বেশী পায়। ‘

    জোবাইদা নাসরিন বলেন, কমবেশি সবাই স্বীকার করেন যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র টেকসই হয়নি বা তার শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত হয় নি কারণ দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেও  কোনো রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো গণতন্ত্র বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি । গণতন্ত্রের চলমান  সংকট বা সম্ভাব্য বহির্বিশ্বে সম্পর্কের সংকটের বিষয়টি কল্পনাপ্রসূত নয় ।

    বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, মানবাধিকারের স্বর্ণযুগে গণতন্ত্র ছাড়া একটি দেশ চলবে, ভোটের অধিকার হারা জনগণের কথা বলার অধিকার রুদ্ধ করবেন ; আবার একই সাথে মানবাধিকার ও নির্বাচন প্রশ্নে বহির্বিশ্বের পরামর্শকে, কথা বলাকে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করবেন- এটাতে হয় না। বহির্বিশ্বের খবরদারি বা নাকগলানো বন্ধ হবে যখন বাংলাদেশ গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।

    যুক্তরাজ্যের প্রসিদ্ধ চ্যাটাম হাউজে কর্মরত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ- রাজনীতি গবেষক স্টিপেন ডগলাস স্মিথ মনে করেন, একটি দেশের  ভূ রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবর্তন সে দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দল বা তাদের মতাদর্শের উপর যতটুকু না নির্ভর করে তারচেয়ে বেশি নির্ভর করে দেশের গন্ডির বাইরের পর্যবেক্ষক ও বন্ধু রাষ্ট্রের উপর। রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার মানসিকতা গণতন্ত্রের বিকাশের পথরুদ্ধ করে দেয়। ২০০৬ সালে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তা-ই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতার একটা বড় উদাহরণ। অন্যান্য সূচকের মধ্যে রয়েছে মুক্তমত রুদ্ধ করার কৌশল,  পার্লামেন্টের অকার্যকারিতা, আইনের শাসনের অভাব, বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা – সর্বপরি দেশের জনগণের প্রতি ‘জবাবদিহি ‘ এড়িয়ে চলার রাজনৈতিক  মানষিকতা । ‘

    তবে,  বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব যতটা আগ্রহী, মধ্যপ্রাচ্যের  দেশগুলো এ ইস্যুতে ততটাই নিরব।  নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতায় বসার জন্য বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের অভিযোগ  দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের। এমন বাস্তবতায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আলোচনা দেশের গন্ডি অতিক্রমের বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর