নাদিরা শিমু :::
রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন, পাসপোর্ট তৈরি করে দেবার দালাল চক্র আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় জমির ভূয়া দলিল, বিদ্যুৎ বিল তৈরি করে রোহিঙ্গাদের বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে জাতীয় পরিচয় পত্র। সেই পরিচয় পত্র ব্যবহার করে অনায়াসে পাসপোর্ট তৈরি করে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ। চলতি মাসের শুরুতে জাল এনআইডি তৈরির সাথে জড়িত তিনজনকে আটক করে পুলিশ। সেই সুত্র ধরে মিলছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতার করা হয় জেলা নির্বাচন কমিশনের আলোচিত কর্মচারী জয়নালকেও। ২৩ জানুয়ারি পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াত চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।কিন্তু কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না রোহিঙ্গাদের বিদেশ যাত্রা, এনআইডি তৈরি।
আসাদউল্লাহ নামের এক রোহিঙ্গা যুবক ২০১৭ সালে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন। উখিয়া উপজেলার থাইংখালী ১২ নম্বর ক্যাম্পে বসবাসরত অবস্থায় ভূয় এনআইডি, জাতীয়তা সনদ পত্র, পাসপোর্ট সব কিছুই বানিয়েছেন দালালদের মাধ্যমে । সৌদি আরব যাবার পথে শুক্রবার শাহ আমানত বিমানবন্দরে গোয়েন্দা পুলিশ তাকে আটক করেন। তার দাবি সৌদি আরব যাবার জন্য ২ লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এক ব্যক্তি তাকে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং সৌদি আববের ওমরাহ ভিসা সংগ্রহ করে দিয়েছিল। কীভাবে কী হয়েছে সেটা তিনি কিছুই জানেন না; দালাল ছাড়া কাউকে তিনি চেনেন না।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে জেদ্দা রওনা দেবার মাঝপথে আটক মিনারমারের নাগরিক আসাদ উল্লাহর পাসপোর্টে ব্যবহার করা হয়েছে চট্টগ্রামের ঠিকানা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আটক ওই যুবকের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রও মিলেছে।
গোয়েন্দা পুলিশের জালে ধরা পড়া আসাদ উল্লাহ বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশ যাবার সব আয়োজনই করে ফেলেছিলেন। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ভিসা সব প্রক্রিয়া শেষে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিমানবন্দরেও, তবে শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক হন তিনি। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে শুক্রবার তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তার জেদ্দা যাবার কথা ছিল।
তাকে গ্রেপ্তারের পর তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে চট্টগ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করেন ওই রোহিঙ্গা যুবক। তার কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যেমন রয়েছে, তেমনি ওই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কোভিডের টিকা নেওয়ার সনদও সংগ্রহ করেছেন।গ্রেপ্তার রোহিঙ্গা যুবক আসাদউল্লাহ কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন তা অনুসন্ধান করছেন চট্টগ্রামের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এরআগে চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন নির্বাচন কমিশনের সার্ভার হ্যাক করে ভূয়া এনআইডি তৈরির দালালচক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। কক্সবাজারের জনপ্রতিনিধি, নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী থেকে শুরু অনেকেই এই প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত এমন তথ্য পেয়েছিলেন শরীফ উদ্দিন। নির্বাচন কমিশনের সচিবের বিরুদ্ধে মামলার পরপরই শরীফ উদ্দিনকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছিল। সুত্রমতে, মাঝখানে কিছুদিন কঠোর নজরদারির কারণে রোহিঙ্গাদের জাল এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরি কষ্টসাধ্য হলেও, বর্তমানে আবার একই দালাল চক্র মাঠে সক্রিয় রয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) নিহাদ আদনান তাইয়ান জানান, পাসপোর্ট অফিসে না গিয়েই দালালের মাধ্যমে তা বানানোর দাবি করেছেন ওই যুবক। আসাদউল্লাহর বড় ভাই সৌদি প্রবাসী। ওমরাহ ভিসা নিয়ে তিনি সেখানে পালিয়ে যাচ্ছিলেন।
গোয়েন্দা পুলিশের সুত্রমতে, আসাদ তার নামে গত অক্টোবরে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র বানান। ডিসেম্বরে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভিসা ইস্যু করিয়েছিলেন । পাসপোর্ট ও এনআইডি তৈরিতে আসাদউল্লাহ পাসপোর্টে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। আর জরুরি যোগাযোগে লিখেছেন স্ত্রীর নাম। চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানার ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে পাসপোর্টে।
পাসপোর্টে আসাদউল্লাহ তার বাবার নাম উল্লেখ করেছেন মমতাজুল হক, মায়ের নাম দিয়েছেন আমেনা খাতুন। কিন্তু তার রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্ডে বাবার নাম মো. কাছিস ও মার নাম উল্লেখ করা হয়েছে শাহেরা খাতুন। জিজ্ঞাসাবাদে পাসপোর্ট সহ সব কাগজপত্র ভুয়া বলে স্বীকার করেছেন আসাদউল্লাহ।
আসাদউল্লাহ উখিয়া উপজেলার থাইংখালী ১২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকেন। গত ৯ জানুয়ারি ক্যাম্পে সংগঠিত একটি হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামিও তিনি বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিহাদ।এজন্য তাকে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশ তার কাছ থেকে জব্দ করা পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
পুলিশের কাছে আসাদউল্লাহ দাবি করেছেন আগে তিনি কখনও চট্টগ্রামে আসেননি । এমনকি পাসপোর্টের জন্যও পাসপোর্ট অফিসেও যান নি । যে দালালের সাথে তার ‘কন্ট্রাক্ট’ হয়েছিল। সে ব্যক্তিই তাকে সবকিছু তৈরি করে পৌঁছে দিয়েছেন। পাসপোর্ট অফিসে না গিয়ে কিভাবে পাসপোর্ট পেলেন- এমন তথ্য ভাবাচ্ছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের।
গোয়েন্দা পুলিশের সুত্রমতে, পাসপোর্ট অফিসে না গিয়েও কীভাবে পাসপোর্ট করা হচ্ছে, সে প্রক্রিয়ায় কারা জড়িত তাদের শনাক্ত করতে কাজ করা হচ্ছে। আসাদকে পাসপোর্ট ও এনআইডি তৈরি করে দেয়া দালালকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
আসাদউল্লাহর কাছ থেকে জব্দ করা পাসপোর্ট অনুযায়ী পাসপোর্টে তার স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের লাওয়ারখিল গ্রাম। জরুরি যোগাযোগের কলামে উল্লেখ করা হয়েছে স্ত্রীর নাম শাহনাজ। ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে নগরীর ডবলমুরিং থানার বার কোয়ার্টার ৭ নম্বর গলি।
বর্তমানে ই-পাসপোর্টের আবেদনকারীকে উপস্থিত থেকে ছবি তোলা, আঙ্গুলের ছাপ, আইরিশ প্রদান করতে হয়। নতুন পাসপোর্টের আবেদন করলে পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে আবেদনকারীকে পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়। এত নজরদারির মধ্যেও কিভাবে জাল এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরি করেছে সেটি নিয়ে কোন তথ্য দিতে পারেনি জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের কাছেও বিষয়টি অবিশ্বাস্য ঠেকছে।
তবে গোয়েন্দা পুলিশকে আসাদ জানিয়েছেন গত বছরের ২০ অক্টোবর তিনি ১০ বছর মেয়াদী ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ৮ ডিসেম্বর তার পাসপোর্টটি ইস্যু করা হয়। পাসপোর্ট অনুযায়ী ২০৩২ সালের ২৬ নভেম্বর তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে।আর ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানার একটি বাসার ঠিকানা রয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই পাসপোর্টের আবেদন করেছেন ওই যুবক।চট্টগ্রামের দুইটি আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের মধ্যে আসাদউল্লাহ চান্দগাঁও (পাঁচলাইশ) কার্যালয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেন।
এ কার্যালয়ের উপ পরিচালক তারিক সালমান বলেন, “পাসপোর্ট কার্যালয়ে না গিয়ে কোনোভাবেই পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব নয়। আঙ্গুলের ছাপ, আইরিশ প্রদান করতে হয়। যেগুলো অন্যজনের মাধ্যমে কোনভাবেই সম্ভব নয়। পাসপোর্টের আবেদন করা হলে সেগুলো সব সার্ভার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করে নেওয়া হয়। আর পুলিশ প্রতিবেদন ছাড়া কোনোভাবেই পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব নয়।”
রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতি ও পাসপোর্ট তৈরি প্রক্রিয়ার সাথে প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে এমন তথ্য দেশ কাঁপিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের ৭টি ল্যাপটপ রহস্যজনকভাবে চুরি হওয়া ও এক ল্যাপটপে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার করার ঘটনাটি উদ্ঘাটিত হলে বেকায়দায় পড়েন সাবেক এক সিনিয়র সচিব ( বর্তমানে অবসরে)। তখন এনআইডি জালিয়াতিতে নির্বাচন কমিশনের পরিচালক খোরশেদ আলমের নামও আসে তদন্তে। আসে কক্সবাজারের পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানসহ দুই ডজনেরও বেশি জনপ্রতিনিধির নাম। এ ঘটনায় ২০টি মামলাও দায়ের করেন মো. দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সুত্র জানান, নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অফিসে এমন জালিয়াতির সাথে জড়িত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অতীতে ব্যবস্থা না নেয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে বর্তমানে৷
জানা যায় , জালিয়াতির মাধ্যমে ১৩ রোহিঙ্গাকে এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট পেতে সহায়তার অভিযোগে কুমিল্লার অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও তিন পুলিশ পরিদর্শকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে মামলা করেছিলেন দুদকের তৎকালীন উপ সহকারী পরিচালক শরিফ উদ্দিন। মামলায় অভিযুক্তদের অনেকেই লঘু দন্ড পেয়ে বহাল থাকলেও চাকরি গেছে শরীফ উদ্দিনের। দুদকের নথি বিশ্লেষণ করে জানা যায় , রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতির তদন্ত শেষে শরীফ উদ্দিন যাদের বিরুদ্ধে মামলা সুপারিশ করেছিলেন তাদের মধ্য নির্বাচন কমিশনের কর্মচারীরা পেয়েছেন লঘু দ্বন্দ্ব। অনেককেই পুনরায় ভালো জায়গায় পোস্টিং দেয়া হয়েছে। আর হাইকোর্টকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কক্সবাজারে জাল এনআইডি তৈরি করা অনেকেই নিষেধাজ্ঞার রায় এনেছেন। অভিযুক্তদের অনেকেই জাল এনআইডি ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। সুত্রমতে, নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তারাও এমন জালিয়াতি চক্রকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কতজন লোক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছে এমন কোন পরিসংখ্যান নেই। কারণ তারা রোহিঙ্গা পরিচয়ে বিদেশে যায়নি।