22 C
Dhaka
Thursday, February 13, 2025
More

    আইএমএফের ঋণ সামনে অর্থনৈতিক ক্ষত বাড়াবে

    আরও পড়ুন

    ওয়াহিদ জামান ::

    বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দায় কোন দেশেরই অর্থনীতি ভালো নয় ; তবে বাংলাদেশের বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে এই মন্দার কারনে নয়। করোনাকালের স্থবিরতাও এর পেছনে দায়ী নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপদের মুখোমুখিতে ফেলা হয়েছে ২০১৪ সালের পর থেকে অনুসরণ করা নীতি  ; যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। তবে আইএমএফের ঋণ প্রাপ্তি নিয়ে অর্থনীতির ক্ষত সারানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু জনগণের জন্য এই ঋণ প্রাপ্তিতে কোন সুখবর নেই। কেন?

    আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের  সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের অনুমোদন দিয়েছে। রুগ্ন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, দীর্ঘমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংস্কার ত্বরান্বিত করতে আইএমএফ দেয়া শর্তে  জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে ২০টি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ  করে দেয়া হয়েছে -এগুলো দেশের জন্য ইতিবাচক। তবে অর্থনীতির উপর এসব প্রভাব পড়বে।কারণ সরকার সামনের দিনগুলোতে আইএমএফের ঋণের অজুহাতেই জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ  থেকে শুরু করে গৃহস্থালি নুন- সবকিছুর উপরই ঋণের যেভাব পড়বে -সেটি সবচেয়ে বেশি ভুগাবে ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনযাপনকে। মধ্যবিত্ত,  নিম্মবৃত্তের জন্য ঋণে কোন সুখবর নেই। দেশের অর্থনীতির পেছনের ক্ষত সারাতে কতদিন লাগবে সেটি বলাও কঠিন।

    আইএমএফ ঋন প্রাপ্তিতে যেসব শর্ত দিয়েছিলো -সেগুলো খুব কঠিন কিছু ছিলো না। সরকারও গ্যাস বিদ্যুৎ, তেলের চায় দাম বাড়াতে- আইএমএফ সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে সরকার আরও ঋণ নিতে চায় – আইএমএফের ঋণ প্রাপ্তি  ভবিষ্যতের সেসব ক্রেডিট চুক্তিকে উৎসাহিত করবে। আইএমএফও চায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য পর্যায়ক্রমিক সূত্র-ভিত্তিক মূল্য ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। কিন্তু তা করলে পেট্রোলিয়ামের দাম আরও বাড়তে পারে, সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতি করতে পারে, ক্ষতি করতে পারে মোট দেশজ উপাদানকে।  সেই সাথে সাধারণ মানুষের  ক্রয়ক্ষমতাকে।

    তীব্র ডলার সংকটের কারণ  বর্তমানে আমদানি ব্যয় বাড়া অন্যতম হলেও স্বাভাবিক বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাওয়ার খেসারত ; বললে ভুল হবে না। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘদিন থেকে ডলারের বাজার নিজস্ব রিজার্ভ থেকে  ডলার ছেড়ে কিংবা অতিরিক্ত ডলার বাজার থেকে সংগ্রহ করে ডলারের মুল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। চাহিদা যোগান অনুযায়ী ডলারের দাম নির্ধারনের যে প্রক্রিয়া সেটিকে পাত্তা দেয়া হয় নি। ফলে ডলারের দাম ধরে রাখা কোনভাবেই সম্ভব হয় নি। এমন শিয়াল পন্ডিতির ফলাফল কেমন হবে সেটি আমরা ইতিমধ্যে উপলব্ধি করেছি।

    তর্কের খাতিরে অনেকেই বর্তমানে আমদানি ব্যয় বাড়ার কথা বলবেন জানি। বলবেন কেন ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু ‘ডলারের সংকট’  সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঝুঁকি ফেলে দিয়েছে। শুধু ২০১৪ সালের পর- এক  বছর, দুই বছর, তিন বছর বা পাঁচ বছর মেয়াদি বেসরকারি ঋণ যেগুলো বিদেশ থেকে অফশোর ব্যাংকিং এর মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। স্বল্প সুদের ঋণ। সেগুলোর ম্যাচুরিটি টাইম আমাদের অর্থনীতিতে কি ক্ষতি করবে সেই বিষয়টি আলোচনায় আনা হয় নি। ধরুন আপনি দেশের বাজারে নয় শতাংশ সুদে ঋণ না নিয়ে এক লাখ ডলার ঋণ নিয়েছেন। যখন ঋণ নিয়েছেন তখন ডলারের দাম ছিলো আশি টাকা, যখন সেই ঋণ রিনিউ করেছেন তখন ডলারের দাম পরিশোধ করেছেন ৯০ টাকা করে। এখন সেই ঋণ পরিশোধ করতে আপনাকে দিতে হচ্ছে ১০০ টাকা। ডলার বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এক লাখ ডলারের বিপরীতে আজকের বাজারে আপনি যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে সেটি নিশ্চিতভাবে বিনিয়োগের আরআর এর( রেইট অব রিটার্ন) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এভাবে শুধু সরকার নয় বেসরকারি খাতও স্বল্পসুদে বিনিয়োগ এনে দেশের অর্থনীতিতে খাল কেটে কুমির ডুকিয়েছেন। তার খেসারত তো দিতেই হবে। অফসোর ব্যাংকিং এর মাধ্যমে দেশে আনা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকালীন সময়ে ডলারের চাহিদা বাড়বে সেটি বুঝার জন্য  রকেট সাইন্স জানার দরকার নেই। ধরুন, এভাবে নেয়া একশোটি ঋণ এই বছর পরিশোধ করতে হবে। হয়তো গেলো পাঁচ বছর শুধু সুদ পরিশোধ করেছেন -এখন ঋণের আসল টাকা পরিশোধের জন্য একশো জন ব্যবসায়ীর কত ডলারের প্রয়োজন?

    ফিরে যাই প্রসঙ্গে ; আইএমএফ আমাদের ঋণ পাবার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে বলেছে। সেই সুযোগে সরকার গ্যাসসহ সব ধরনের ইউটিলিটি বিল বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউটিলিটি খাতে বাড়তি ব্যয় দেশের প্রতিটি উৎপাদন  খাতকে প্রভাবিত করবে৷ দেশের মোট জিডিপি প্রভাবিত হবে। ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যয় বাড়ানোর কারণে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়বে ; খুব সহজ অংক। সবচেয়ে আশংকা তৈরি হয়েছে দেশের কৃষিজ উৎপাদন নিয়ে। কারণ সেচসহ কৃষির প্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি কৃষিজ উৎপাদনকে ব্যাহত করবে। দেশের কৃষকরা কৃষিকাজে নিরুৎসাহিত হলে,  কৃষি পণ্য আমদানির ব্যয় মেটানোর ক্ষমতা আসলে বাংলাদেশের নেই৷  জ্বালানী খাতে ভর্তুকি এবং মূল্য সমন্বয়ের ক্ষেত্রে, বিনিময় হার এবং সুদের হারের মতোই পুরো বিষয়টি  বাজারের ছেড়ে দেয়া উচিত। বাস্তবতা হচ্ছে  বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছে । একারণে বিপিসি ভেঙ্গে বেসরকারীকরণ করা উচিত এবং পেট্রোলিয়াম এবং অন্যান্য জ্বালানী ক্রয় বিক্রয়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাজারের মুডের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু সেটি করা সরকারের মর্জির উপর নির্ভর করে।

    এছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে একটি পরিচিত টার্মস হচ্ছে ডিফার্ট এলসি। সহজ ভাষায় হচ্ছে বাকিতে পণ্য কেনা।  এমন ‘ঋণপত্র ‘ আপাত দৃষ্টিতে বড় ধরনের দায়। ক্রেডিট রেটিং বাড়ার কারণে ডেফার্ট এলসিতে পণ্য আমদানির হিড়িক পড়বে। আইএমএফ যেহেতু ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশকে সেই হিসেবে ডেফার্ট এলসিতে পণ্য ক্রয় করার সুযোগ অবারিত হয়েছে৷ ইতিমধ্যে সরকার মধ্যপ্রাচ্য থেকে ডেফার্ট এলসির মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের পথে হাঁটছে। সাময়িক স্বস্তি থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদে ডেফার্ট এলসির ফলাফল ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে পড়বে।

    ঋণ পাবার আনন্দ উৎযাপন না করে ঋণের সুষম বণ্টন বা ব্যবহার করার জন্য আইন প্রয়োজন। পাশের দেশ ভারতে ২০০৩ সালে,  সরকার ‘ফিসকাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’ পাশ করেছিল।  ব্যষ্টিক দায়বদ্ধতা  নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকার অযথা পাবলিক প্রকল্প গ্রহণ করেনি বা অহেতুক অর্থ অপচয়ের মতো প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে না। এটি এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে।  দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে এমন রেসপন্সিবিলিটি এ্যাক্ট বাংলাদেশেও প্রয়োজন রয়েছে।

    আইএমএফের শর্ত প্রতিপালনের প্রয়োজনীয়তা মোকাবেলা করার জন্য, বাংলাদেশের একটি রাজস্ব দায়িত্ব আইনেরও প্রয়োজন হতে পারে যা কোনো অপ্রয়োজনীয় মেগাপ্রজেক্টের জন্য সরকারকে দায়ী করবে। দেশের ব্যষ্টিক অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতিতে এমন আইন হওয়া জরুরি। মোটকথা,  আইএমএফের ঋণে সমস্যা নয় ; সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনায়। প্রকৃতপক্ষে একটি দেশ কোনো খরচ ছাড়াই আইএমএফের তহবিলগুলি পেতে পারে, সেই ফান্ড বা অর্থকে কাঠামোগত পরিবর্তন বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করতে পারে-  যা তার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে, এবং তারপর দশ বছর পরে শূন্য সুদে ঋণ পরিশোধ করতে পারে।  যখন দেশটি সংস্কার থেকে উপকৃত হতে সক্ষম হবে তবে এমন ঋণের স্বার্থকতা। আইএমএফের এমন তহবিলে দীর্ঘমেয়াদী  পরিশোধের সুযোগ একটি দেশের ক্ষতিগ্রস্ত  অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে  সুষম পথ তৈরি করে দেয়। এই ধরনের তহবিল শুধুমাত্র BOP-এর উপর চাপ কমায় না, বরং সরকারকে একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য একটি সুষম আর্থিক ভিত্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি করে দেয়।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর