20 C
Dhaka
Friday, February 14, 2025
More

    বিদেশে জিম্মি হচ্ছেন প্রবাসী, মুক্তিপণ দেশে

    আরও পড়ুন

    খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ::

    মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের নানা কৌশলে জিম্মি করে দেশ থেকে মুক্তিপণ আদায় করছে একটি চক্র। কখনও ব্যবসায়িক পাওনা আদায়, জায়গা জমির দ্বন্দে, ব্যক্তিগত পাওনা আদায়ের সমঝোতা করতে দেশে রাজনৈতিক পেশিশক্তি ব্যবহার করছে সংঘবদ্ধ চক্রটি।

    সুত্রমতে, দুবাইয়ে বসবাসরত ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান, ফেন্সি নাসির, চট্টগ্রাম ভিক্তিক শিবিরের পালিয়ে ক্যাডার বাহিনী এমন জিম্মি বাণিজ্য চালাচ্ছে সৌদি আরব, দুবাই, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে। একই চক্র মালয়েশিয়ায়ও বাংলাদেশী বংশদ্ভূত ব্যবসায়ীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে দেশ থেকে। স্বজনদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এমন ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আনতেও ভয় পাচ্ছেন ভুক্তভোগী পরিবার।

    মানিক হোসেন নামের এক সৌদি প্রবাসী নিখোঁজ হন গেল বছরের ডিসেম্বরে। স্ত্রীর সাথে মানিকের শেষ কথোপকথনে সে জানায় সৌদি আরবে তার পাসপোর্ট, ওয়ার্ক পারমিট জব্দ করে রেখেছে একটি চক্র। তারা নিজেদের পাওনা আদায় করতে এমন কৌশল অবলম্বন করেছে। মানিক স্ত্রীকে ফ্লাট বিক্রি করে টাকা যোগার করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো কথা বলে। স্ত্রী রাজি না হবার কারণে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে মানিক। কিন্তু নিজের স্ত্রী সন্তানদের কাছে না যাবার কারণে চিন্তিত স্বজনরা ১৪ই ডিসেম্বর নিখোঁজের ডায়েরি করেন চট্টগ্রামের খুলশী থানায়৷ পুলিশ ফ্লাটের ক্রেতা পরিচয় দেয়া মনির মোল্লাকে শনাক্ত করার পর খোঁজ মেলে মানিকের। নগরের মোটেল সৈকত থেকে মনির মোল্লা ও নিউটন নামের দুই ব্যক্তিকে আটক করার পর তারা জানায় ‘মানিক’ নিখোঁজ নন। পাশ্ববর্তী হোটেল এশিয়ান ‘এসআর’ এ রয়েছে মানিক। পরে পুলিশ সেখান থেকে প্রবাসী মানিককে উদ্ধার করে স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে পৌঁছে দেয়।

    মানিকের স্ত্রী বলেন, পাওনাদারদের ভয়ে আত্নগোপন করার গল্পো সাজালেও বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়। থানায় মানিক বিশ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বলে জানালেও, পরের দিন সেই অংক বলেন ত্রিশ লাখ টাকা। সপ্তাহ না যেতেই কথিত পাওনাদারদের পাওনার অংক দাঁড়ায় ৫২ লাখ টাকায়। দীর্ঘ ১৮ বছর সৌদি আরবে বসবাস করা মানিক কেন একসাথে এত টাকা কারো কাছ থেকে ধার করবে,সেই হিসেবে মিলাতে পারছি না। দেশে ফিরেও কেন বাসায় আসলো না? কি কারণে স্ত্রী সন্তানের শেষ আশ্রয়স্থল ‘ফ্লাট’ বিক্রি করে টাকা একটি চক্রের হাতে তুলে দিতে চায়! ‘

    উদ্ধার করার সময় হোটেল সৈকতে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী ইউনুচ গণি। সম্পর্কে মানিকের ভায়রা। তিনি জানান, ‘ পাওনাদারের পক্ষে এক ব্যক্তি পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছিলো। সেই সুত্র ধরে লাপাত্তা হওয়া মানিককে খুঁজে পায় পুলিশ। মনির মোল্লার দাবি সৌদি আরবে মানিকের দেনার দায়িত্ব নিয়েছেন মুনির মোল্লার ভাই আকরাম মোল্লা। দেশে ফিরে মানিক ফ্লাট বিক্রি করে টাকা তাদের হাতে তুলে দেবার কথা। ফ্লাটের জন্য মানিকের কাছে থেকে ‘পাওয়ার অব এটর্নি ‘ নিয়েছেন মুনির মোল্লা। ‘

    খুলশী থানা সুত্রে জানা যায়, ‘ উদ্ধার হবার পর মানিক হোসেন নিজের স্ত্র-সন্তানের কাছে ফিরতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে বুঝিয়ে স্ত্রীর সাথে বাসায় পাঠানো হয়৷ মানিকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে ডিসেম্বরের তিন তারিখ দেশে ফিরেছেন। ফ্লাট বিক্রি করতে বাধা দেবেন এমন আশংকায় সৌদি আরব থেকে ফিরে স্ত্রী,সন্তান,স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করেন নি। ‘

    জানা যায় , লালখানবাজার এলাকায় মিশন প্রপার্টিজের মাতৃছায়া আবাসিক প্রকল্পের একটি ফ্লাটে বসবাস করে আসছেন মানিকের পরিবার। ফ্লাটটি কেনার সময় নিজের বাবার কাছ থেকে বেশ কিছু টাকাও নিয়েছেন মানিকের স্ত্রী রাশেদা খানম মুনিরা৷ প্রবাসের পাওনা পরিশোধের কথা বলে ফ্লাটটি বিক্রি করে দেবার জন্য স্ত্রীকে চাপ দিতে থাকেন মানিক হোসেন। মানিকের স্ত্রী রাশেদা খানম ২২ শে জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বরাবর লিখিতভাবে জানান বিষয়টি। স্থানীয় কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলালের শরণাপন্ন হন মানিকের শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আবদুস সবুর আনসারী। কিন্তু ফ্লাট বিক্রি করে কথিত পাওনা টাকা পরিশোধ ও সৌদি আরবে ফিরে যেতে অনড় মানিক হোসেন।

    অনুসন্ধানে জানা যায়, ফ্লাটটির পাওয়ার অব এটর্নি নেয়া মনির হোসেন অন্তত দুইমাস যাবত চট্টগ্রামের অভিজাত হোটেল সৈকতে অবস্থান করছেন। তার নিজের জেলা গোপালগন্জে। পুলিশ মানিককে উদ্ধারের পর মনির মোল্লাকে ছেড়ে দেয়। তার দাবি, সৌদি আরবে বসবাসরত ভাই আকরামের পাওনার বিনিময়ে ফ্লাটটি কেনার জন্য পাওয়ার অব এটর্নি দলিল করেছেন। মানিকের স্ত্রী সন্তান ফ্লাটটি ছেড়ে না দিলে আগ্রহী ক্রেতার কাছে ফ্লাট বিক্রি করে দেবেন -এমন কথা জানিয়ে মুনিরার বাবাকে ফোন করেছেন মনির মোল্লা।

    এদিকে, সৌদি আরব থেকে স্ত্রীকে পাঠানো মানিকের শেষ এসএমএস অনুযায়ী মনির মোল্লার কাছে মানিকের দুই লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। স্ত্রীকে পাওনাদারের কাছে ফ্লাটটি ছেড়ে দেবার অনুরোধ করার পর থেকে লাপাত্তা হন মানিক।

    শুধু সৌদি প্রবাসী মানিক হোসেন নয় মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের কাছে পরিচিত বিষয় ‘ ‘ প্রবলেম সল্ভার’। নাম প্রকাশে একাধিক প্রবাসী এমন সন্ত্রাসী চক্রের বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। দেশের বাড়িতে নানা ঝামেলা সমাধানের এমন সিন্ডিকেট তৈরি করে দেদারসে ‘জিম্মি নাটক’ করে যাচ্ছে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা। দেশের বাইরে কোন কাজকর্ম না করেই আয়েশী জীবনযাপন করছেন দেশের বিভিন্ন জেলার অন্তত দুই ডজন সন্ত্রাসী।গেলো বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দীর্ঘ দুই দশক বিদেশে পালিয়ে থাকা নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী জাকির খানকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী জাকির খান দীর্ঘ প্রায় একুশ বছর বিদেশে পলাতক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি মধ্যপ্রাচ্যে থেকে ভারত হয়ে দেশে আসেন। সুত্রমতে প্রবাসীদের জিম্মি করে টাকার বিনিময়ে পাওনাদার-দেনাদার দ্বন্দ্ব মেটানোর প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন তিনি৷

    সুত্রমতে, ২০০০ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রামে ৬ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীসহ আটজনকে হত্যার ঘটনায় নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া শিবিরের ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন খানও নিজের বলয় তৈরি করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে । বর্তমানে ভারতে থাকা সাজ্জাদের ১৭ জন সহযোগী নিয়ন্ত্রণ করছে দুবাই ও সৌদি আরবের জিম্মি বাণিজ্য। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে তাদের দুর্দান্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে। ২০১৯ সালে কাতারপ্রবাসী এক ব্যবসায়ীর কাছে সাজ্জাদের নামে দাবি করা হয় ৪ লাখ টাকা। চাঁদা দিতে না চাইলে চট্টগ্রামে তার দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হলে নড়েচড়ে বসে পুলিশ।

    ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আর্থিক দেনাপাওনার সমঝোতার অধিকাংশ কেসই স্বর্ণ চোরাচালান সংক্রান্ত। অনেকেই দেশে আসার সময় চোরকারবারীদের কাছ থেকে বিশেষ শর্তে স্বর্ণ নিয়ে আসেন। অনেকক্ষেত্রেই স্বর্ণ নিয়ে দেশে ফেরার পর লাপাত্তা হয়ে যান তারা। এমন ক্ষেত্রে আইনের সহযোগিতা নয়, এসব স্বর্ণের বার উদ্ধার করতে মধ্যেপ্রাচ্য জুড়ে গড়ে উঠা বাংলাদেশী সন্ত্রাসী চক্রের উপর নির্ভর করেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। সুত্রমতে, ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশনে স্বর্ণের বার বা টাকা উদ্ধার করার কাজটি করে সংঘবদ্ধ জিম্মি চক্র।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর