রাহাত আহমেদ
গৌতম আদানি সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও বাংলাদেশে একটি বিতর্কিত নাম। রক্তচোষা এই ব্যবসায়ীর প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়েছে দেশের বিদ্যুৎখাত। ৬ টাকা ৮৯ পয়সায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়েছে বাংলাদেশকে। কয়লার দামবৃদ্ধি ও ডলারের দামের কারণে সেই বিদ্যুৎ খরচ তিনগুণ ছুঁয়েছে, যেটি এখন প্রায় ইউনিট প্রতি ১৭ টাকা।
ডলারের সংকট থাকলেও বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই বলা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। সুত্রমতে, চুক্তি অনুসারে ভারতীয় শিল্পগ্রুপ আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে মার্চের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে। ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগ ও আদানি পাওয়ার লিমিটেড, ইন্ডিয়ার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল । এ চুক্তি বাস্তবায়নে আদানি কর্তৃক ঝাড়খন্ডে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। ইতিমধ্যে ডেডিকেটেড সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়ায় দুটি সাবস্টেশন ও অন্যান্য সঞ্চালন কাজ বাস্তবায়নে কাজ প্রায় শেষ। প্রাথমিকভাবে চুক্তিটি ২৫ বছর মেয়াদী। কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট দৈনিক ৮০০ করে মোট ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। চুক্তি মাফিক আদানির এই প্ল্যান্ট থেকে ৮০০ মেগাওয়াটের দুটির মধ্যে একটি ইউনিট এখন প্রায় প্রস্তুত কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রস্তুত হলেও শেষ মুহূর্তে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে আদানি গ্রুপ। আমদানি খরচ বৃদ্ধি ও মার্কিন শর্ট-সেলার হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টের পর মুলধন ঘাটতির কারনে আদানির বিদ্যুৎ পাবার আশা কমে আসছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন,
‘ আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কমিশনিং হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই, মার্চের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে।’
তবে, প্রশ্ন উঠেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানি খরচের পার্থক্য নিয়ে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সুত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সঞ্চালন লাইন নির্মাণও যুক্ত আদানির বিদ্যুৎ প্যাকেজে । বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার যে দাম তাতে ১৪ থেকে ১৭ ডলার হবে। ডলার রেট ১০০ টাকা হিসাব করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৭ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বৃদ্ধি পেলে বাড়বে বিদ্যুৎ এর দাম ; এমন সংকট ভাবাচ্ছে বাংলাদেশকে৷
তবে বিদ্যুৎ সচিব বলেন ,
‘ এটি ফিক্সড নয়। কয়লার দাম কমলে বিদুতের দামও কমবে। আমাদের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতও এখন প্রতি ইউনিট প্রায় ১৬ টাকা করে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন শীত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকার কারণে বাড়তি চাপ যোগ হতে পারে৷ বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের চাহিদা তীব্র না থাকায় এই বিদ্যুৎ খুব বেশি উপকারে আসবে না। উল্টো আদানির বিদ্যুৎ সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে। এক মাসেই এক ইউনিটের শুধু কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্টে আদানি পাবে ২৫০ কোটি টাকার মতো।
এক মাসেই এক ইউনিটের শুধু কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্টে আদানি পাবে ২৫০ কোটি টাকার মতো।
বিজেপি সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ এই ধনকুবের ইতিমধ্যে শেয়ার বাজারে কারসাজি করে পথে বসিয়েছে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নামও জড়িয়েছে সেই সমালোচনায়। ভারতে তাঁর সংস্থাগুলির শেয়ারে ধস নেমেছে। মার্কিন শর্ট-সেলার হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টের পরেই ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শেয়ার মূল্য খুইয়েছে আদানি গোষ্ঠী। বিশ্বের দশতম ধনীর তালিকা থেকেও ছিটকে পড়েছেন গৌতম আদানি। আদানি গোষ্ঠীর সাতটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির বাজার মূলধন এই জানুয়ারি মাসেই ছিল ২২০ বিলিয়ন বা ২২ হাজার কোটি ডলার। সমুদ্রবন্দর, কয়লাখনি, বিদ্যুৎ, খাদ্যপণ্যের ব্যবসা, বিমানবন্দর, আর সবশেষে গণমাধ্যম—সবখানেই ছিল আদানির বিনিয়োগ।
মাত্র তিন বছর আগে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে ভারতের বড় দুই বড় শিল্প গ্রুপ আদানি ও রিলায়েন্স বাংলাদেশে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। আদানি আট দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার এবং রিলায়েন্স তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা জানান দিয়েছিলেন । তবে শেয়ার বাজারে ধস বাংলাদেশকে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশ আদানির কোম্পানিকে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সংশোধনের দাবি জানিয়েছে, অন্যথায় চুক্তি বাতিল করা হবে।
বাংলাদেশের আদানি গ্রুপ তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছিলো ; সেই প্রেক্ষাপট পুরোপুরি ভিন্ন । বলা হয়েছে এরমধ্যে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে এবং বাকি এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র ভারতে স্থাপন করা হবে। ভারতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শুধু বাংলাদেশেই সরবরাহ করা হবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সঞ্চালন লাইনসহ এখানে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এভাবে বিদ্যুৎ কেনায় উচ্চ মুল্যের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ।
কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই আদানি গ্রুপ থেকে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবার আশা বাংলাদেশকে সংকটে ফেলতে পারে – এমন বিশ্লেষণ বিশেষজ্ঞদের। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ক্যাপাসিটি চার্জ বাবত বড় অংকের টাকা নিয়ে যাবে – এমন শংকা বাড়ছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ড। যেখানে শুধু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য আদানি পাওয়ার লিমিটেড গড়ে তুলেছে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার বৃহৎ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প। সব ঠিক থাকলে সামনের মার্চ থেকেই এই বিদ্যুৎ পাবে বাংলাদেশ।এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একক উৎস থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ আন্তঃদেশীয় গ্রিডের মাধ্যমে যোগ হবে দেশের উত্তরাঞ্চলে। এর ফলে অনেকাংশে কমবে উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুৎ ঘাটাতি। বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করে ভারতের ওড়িশায় আদানির নিজস্ব বন্দরে খালাসের পর রেল ওয়াগনে সেই কয়লা পৌঁছাবে গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজির মাধ্যমে কয়লা পুড়িয়েই উৎপাদিত বিদ্যুৎ আসবে বাংলাদেশে।
নথি অনুযায়ী, ঝাড়খন্ডের গড্ডা থেকে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শুরু করে বগুড়া পর্যন্ত পাওয়া যাবে এই বিদ্যুৎ। তবে এর জন্য নির্মাণ করতে হয়েছে ২৪৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন। যার ৯৫ কিলোমিটার পড়েছে ভারতে। বাকি ১৫০ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশ অংশে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশগুলো জ্বালানিসংকটে আছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও সেই প্রভাব পড়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার ও পরিকল্পিত লোডশেডিং করার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের চেষ্টায় আছে বাংলাদেশ । সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্রিডে যুক্ত হওয়াসহ সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে অচিরেই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে। সেই আশায় গুড়ে বালি।
ভারতীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দেয়া ২০১৭ সালের অনুমোদন নথি সূত্রে জানা যায় এই প্রকল্পের কয়লা আমদানি করা হবে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। এত দূর থেকে জাহাজে করে আমদানি এবং এরপর তা বন্দর থেকে ট্রেনের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে আসার উচ্চ খরচের কারণে, ভারতে আদানি শিল্পগোষ্ঠীর এই প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের এই বিরোধ নিয়ে সম্প্রতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেন, ‘আমরা বুঝি যে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কও আমাদের উন্নয়নে সাহায্য করে। আমাদের প্রতিবেশীরা কীভাবে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি থেকে উপকৃত হতে পারে, তা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। আমরা তাদের সঙ্গে সংযোগ, বিদ্যুৎ সঞ্চালন সহজ করার চেষ্টা করেছি। এটি আমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি আমাদের কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আমাদের জন্য আমাদের প্রতিবেশীরাই প্রথম। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে যদি কোনও প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়, তার মানে এই নয় যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ‘
তার এমন মন্তব্য সাম্প্রতিক সংকটে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হবার ইংগিত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে দেশের বিদ্যুৎ ও বন্দর খাতে বিনিয়োগের জন্য আদানি গ্রুপের সাসাথে প্রাথমিক সমঝোতা স্বাক্ষরও হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে প্রস্তাবিত প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও। এমনিতেই অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে তীব্র ডলার সংকটে ভুগছে। যার জন্য আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে । আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে এলে ঋনের ডলারের একটি বড় অংশ দিতে হবে তাদের। এতে দেশের ডলার সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এছাড়া চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ জোন নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে আদানি গ্রুপ। সেই কাজ সংস্থাটি কতখানি সম্পন্ন করতে পারবে -সেটিও দেখার বিষয়। এরআগে, বাংলাদেশে বন্দরের জেটি ও টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গ্রুপটি। এছাড়া দেশের ভোজ্যতেল খাতে বড় বিনিয়োগ আছে আদানি গ্রুপের। ১৯৯৩ সালে রূপচাঁদা, ফরচুন, কিংস, মিজান ও ভিওলা দেশের বাজারে আছে। সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও আদানি গ্রুপ মিলে আদানি উলমার নামে যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলেছে । আদানি গ্রুপের মূলধন কমে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তেমনিভাবে সংস্থাটির অন্যান্য বিনিয়োগ খাতের ভবিষ্যত নিয়েও উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা।