জোবাইর চৌধুরী বাঁশখালীঃ
বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের আলোচিত চেয়ারম্যান মো. লিয়াকত আলীকে চট্টগ্রাম জেলা ডিবি পুলিশ বৃহস্পতিবার ভোরে চট্টগ্রামের সুগন্ধা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও কোন জায়গা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের তথ্য দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) কামরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর পর গন্ডামারা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় দেড় শতাধিক পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। আমি নিজে উপস্থিত থেকে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছি। সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনায় ৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। লিয়াকতের বিরুদ্ধে আগেও ২৪টি মামলা ছিল। চেয়ারম্যান লিয়াকতকে ডিবি পুলিশ চট্টগ্রামস্থ সুগন্ধা আবাসিক এলাকার নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে। তাকে বাঁশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মো. মাইনুল ইসলামের আদালতে সোর্পদ করা হবে ।
তবে গোয়েন্দা পুলিশের আরেকটি সুত্রমতে, গন্ডামারা থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এরআগে ২৪ মামলার আসামী চেয়ারম্যান লিয়াকত তার দলবল নিয়ে গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বালির ঠিকাদারির বিরোধকে কেন্দ্র করে গন্ডামারার ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পুলিশের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ান। প্রত্যক্ষদর্শিরা জানান গুলি ছুঁড়ে ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় লিয়াকত বাহিনী । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। ওইসময় বাঁশখালী থানার ওসি তদন্তসহ ৬ পুলিশ, ঠিকাদার এবং শ্রমিকসহ অন্তত ১৩জন আহত হয়।
হামলাকারীরা ঠিকাদারের মালামালবাহী ৩টি ট্রাকেও ভাংচূর করেছে। তাকে গ্রেফতারের আগে বাঁশখালী থানায় ঠিকাদার, থানা পুলিশ এবং ডিবি পুলিশ বাদী হয়ে আরো ৩টি নতুন মামলা দায়ের করেছে। হামলাকারীদের ইটপাটকেল ও লাঠির আঘাতে বাঁশখালী থানার ওসি তদন্ত সুমন চন্দ্র বনিক(৩৯), এস আই মো. মাসুদ(২৮), এস আই লিটন চাকমা(৩৯), এএসআই নজরুল ইসলাম (৩৫), এএসআই আব্দুল খালেক(৩০) ও পুলিশ সদস্য মফিজুল আলম(২৮), ঠিকাদার মো. সায়মন, শ্রমিকসহ ১৩ জন আহত হয়েছে। ৬ পুলিশকে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান মো. লিয়াকত আলী ও তার বাহিনীর নেতৃত্বে ১৮বার হামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সন্ত্রাসীদের হামলায় মোট ১৩ জন নিহত ও আহত হয়েছে অন্ততঃ ৩ শতাধিক। বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত লিয়াকতের ক্ষমতার খুঁটি রহস্যের বলয়ে ঘেরা। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল গণ্ডামারা ইউনিয়নে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করে বসতভিটা রক্ষা কমিটির ব্যানারে আন্দোলনে পুলিশের সাথে ত্রিমুখী সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়। আন্দোলনকারী বসতভিটা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন লিয়াকত আলী।এসআলম গ্রুপের সাথে গ্রামবাসীর বিরোধের সুযোগ নিয়ে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন লিয়াকত আলী। গেল আট বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। অভিযোগ আছে অবৈধ টাকায় জমি কিনেছেন অন্তত ৭৫ একর। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে তার উষ্কানি দেয়া ভিডিও ব্যবহার করা হলেও বাঁশখালীর আওয়ামীলীগ নেতা এবং প্রশাসন রহস্যজনক কারণে নিরব ছিল।
এছাড়াও গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বহু মামলার আসামী ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লিয়াকত আলী, প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে কটুক্তি করে বক্তব্য দিয়ে দেশব্যাপী আলোচিত হন। বাঁশখালীর বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে টাকা দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অধিকাংশ স্কুলের সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সৃজনশীল প্রশ্নে ‘ তাঁর সাথে বঙ্গবন্ধুর তুলনা করে প্রশ্নপত্র তৈরি করিয়েছিলেন । ওই প্রশ্নপত্রের কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার ১৩ জন শিক্ষক জেল কাটেন। সেই মামলাটি এখনও চলমান।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে গত ২০১৭ সালের ২৫ মে চেয়ারম্যান পদে শপথ গ্রহণের পর ১ বারের জন্যও উপজেলা আইন শৃংখলা সভা ও উপজেলা সমন্বয় সভায় উপস্থিত না থেকে পদ বহাল রেখেছেন। পরবর্তীতে আবারো ২০২২ সালের ৪ আগষ্ট শপথ গ্রহণ করে গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু বাঁশখালী উপজেলা সমন্বয় সভা ও আইনশৃংখলা সভায় উপস্থিত থাকেন না তিনি৷
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাঁশখালী থানা, বাঁশখালী আদালত, আনোয়ারা থানা, বাকলিয়া থানাসহ বিভিন্ন থানায় ১৯৯৪ সাল থেকে পৃথক পৃথক ভাবে নয়জনকে হত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক উৎপাদনকারী আইন, নাশকতার ঘটনা, চেক জালিয়াতিসহ ২৪টি মামলা রয়েছে । আরো ৩টি মামলা হওয়ায় এই নিয়ে ২৭টি মামলার আসামি চেয়ারম্যান লিয়াকত। তবে পূর্বের ২৪টি মামলার মধ্যে কয়েকটিতে জামিন আছেন তিনি। কয়েকটি মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে। ১০/১২টি মামলা তদন্তাধীন ও বিচারাধীন আছে।
রহস্য ঘেরা পলাতক লিয়াকতের ২৪ মামলার কয়েকটি হচ্ছে- ১৯৯৪ সালে গন্ডামারার আবু তাহের ও ১৯৯৯ সালে গন্ডামারার নুরুল কবিরকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল গন্ডামারার মর্তুজা আলী, মো. আংকুর. জাকের আহম্মদ ও জাকের হোসেনসহ ৪ জনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী মোহাম্মদ আলীকেও প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ২০১৪ সালে ১৮৭৮ সনের অস্ত্র আইনের ১৯(এ) মামলা নং ১৭, ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী বিস্ফোরক উৎপাদনকারী আইন ( সংশোধিত ২০০২) এর ৩/৪ এর ধারায় মামলা।