20 C
Dhaka
Friday, February 14, 2025
More

    আবারও রোহিঙ্গাদের ‘এনআইডি’ বানিয়ে দেবার চক্র সক্রিয়

    আরও পড়ুন

    রাহাত আহমেদ ::

    কক্সবাজারের উখিয়া -টেকনাফে রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় পত্র বানিয়ে নিচ্ছে। দুদকের অনুসন্ধান ও মামলা দায়েরের পর কিছুদিন রোহিঙ্গাদের ‘এনআইডি’ বানানোর উপর কড়া নজরদারি থাকলেও বর্তমানে শিথিল। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জাল বিদ্যুৎ বিল, জমির দলিল তৈরি করে জাতীয় পরিচয় পত্র বানানোর হিড়িক পড়েছে জেলা জুড়ে।

    জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ  ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এবং এনআইডি প্রস্তুত থেকে তৈরি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে কঠোর নজরদারির কথা বললে বাস্তব চিত্র ভিন্ন৷

    একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের  বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। তারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এ জালিয়াতির কাজ করে আসছে । জন্ম নিবন্ধন করতে প্রয়োজনী জমির দলিল ও জাল বিদ্যুৎ বিল তৈরি দিচ্ছে একই চক্র।

    রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক সুত্রসতে, রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে সক্রিয় দালাল চক্র ক্যাম্প থেকে এনআইডি করাতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের নিয়োগ করে। এরপর বাংলাদেশি দালাল চক্রের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন, জাতীয়তা সনদপত্র এবং অন্যান্য দলিল তৈরি করে। সর্বশেষ ধাপে নির্বাচন কমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে এনআইডি তৈরি করে দেয়া হচ্ছে।

    সুত্রমতে, এনআইডি তৈরি করতে প্রতি রোহিঙ্গাকে গুণতে হয় এক লাখ ২০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে নির্বাচন অফিসের কর্মচারীরা  নেয় ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা, জন্মনিবন্ধন ও জাতীয়তা সনদ তৈরির আলাতা সিন্ডিকেট নেয় ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর এনআইডি ভেদে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দালাল চক্র লাভ হচ্ছে ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা।

    নির্বাচন কমিশনের সার্ভার হ্যাক করে বেশকিছু রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ভোটার করার বিষয়ে তথ্য বের হয়ে আসে দুদকের তদন্তে। দূর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন উপ সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনের অনুসন্ধানে  কক্সবাজারের  রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও ভোটার তালিকায় নাম অর্ন্তভুক্তির বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হয়। রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার মামলা হওয়ার পর তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এসব মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জালজালিয়াতির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করাও বন্ধ হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের এনআইডি, জন্ম সনদ ও পাসপোর্ট তৈরিতে সহযোগিতা করে থাকে জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই কাজে আইনজীবীদের সহযোগিতার প্রমাণ পেয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই পরিবারের দুইশ রোহিঙ্গাকে এনআইডি-পাসপোর্টসহ সব সুবিধা দিয়েছে এমন অভিযোগ দুদকের একটি মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের অনেকেই এখন প্রবাস জীবনযাপন করছে। ২০১৮ সালে এ সংক্রান্ত ১৩টি মামলা দায়ের হয়। কিন্তু চার বছরে একটি মামলাও নিষ্পত্তি করতে পারেনি দুদক। দুদকের অনুসন্ধানে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার পেছনে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে পুলিশের ছয় কর্মকর্তা, ১০ জন প্রতিনিধি ও এক নির্বাচন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন অফিসের চার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দুই আইনজীবী রয়েছেন।

    ২০২২ সালের ২৬ শে অক্টোবর চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে দশ রোহিঙ্গাকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। জিজ্ঞেসাবাদে তারা জানায়১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বানানোর কন্ট্রাক করেছিলো রোহিঙ্গারা। এ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে রোহিঙ্গাসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল  চট্টগ্রাম গোয়েন্দা পুলিশ।

    গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন কামাল হোসেন, সোনা মিয়া, মো. কামাল, নুরুল আবছার ও সামসু মাস্টার। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অস্থায়ী কর্মচারী পাঁচ ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হলেন ইয়াসিন আরাফাত, নূরনবী, মিজানুর রহমান, ফরহাদুল ইসলাম ও ইমন দাস।নগরের হালিশহর হাউজিং এস্টেট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানে রোহিঙ্গারা এনআইডি করতে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ইসির অস্থায়ী কর্মচারী ডেটা এন্ট্রি অপারেটর।

    জিজ্ঞেসবাদে তারা জানায় জনৈক  সামসু মাস্টার রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা করে নিয়ে  দালাল নুরুল আবছারের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন ও এনআইডি বানিয়ে কাজ করছে।  ঢাকায় একটি চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন করেন আবসার। এরপর সেই জন্মনিবন্ধন দিয়ে রোহিঙ্গাদের নামে এনআইডি তৈরি করে দেয়া হয়। নির্বাচন কমিশনের সার্ভারেও সেই এনআইডিটি দেখা যায়।

    ৩৪টি অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের  বাসস্থান, আহার, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে । শুরুতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ছিল নয় লাখ। এখন বংশবৃদ্ধির পর তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখে। জন্ম নিবন্ধন ও এনআইডি নিয়ে দেশের নাগরিক বনে যাওয়া এসব রোহিঙ্গা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এমন শঙ্কা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের৷

    পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি ভুয়া এনআইডি করে দেওয়ার অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কোতোয়ালি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া দুদকের মামলার অন্যতম আসামি  জয়নালকে চলতি মাসের শুরুতে আবারও গ্রেফতার করে পুলিশ । গ্রেপ্তারের পরে আদালতের স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন অফিসের সার্ভারে ঢুকে তিনি একাই ১ হাজার ৮৪০ রোহিঙ্গাকে ভুয়া এনআইডি বানিয়ে দিয়েছেন।পরদিন  ২রা ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার জন্ম নিবন্ধন সার্ভার হ্যাক করে রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন ও এনআইডি দেওয়া এবং এসব এনআইডি দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ।চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানার দোহাজারী পৌরসভা সহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের সার্ভার আইডি ও পাসওয়ার্ড হ্যাক করে দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ভুয়া জন্মসনদ ও এনআইডি বানিয়ে পাসপোর্ট করে দিচ্ছিল এই চক্রটি। বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে অভিযান চালিয়ে মো. আরিফ, মো. জসিম উদ্দিন ও মো. তারেক নামের  ৩ জন সদস্যকে আটক করে পুলিশ।

    সুত্রমতে, চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও পিরোজপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিদ্যমান ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গারাও ভোটার হয়ে যাচ্ছেন। সারাদেশে ইসির সতর্কতাও কাজে আসেনি। কীভাবে রোহিঙ্গার ভোটার  হচ্ছে, এনআইডি পাচ্ছে—সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ নির্বাচন কমিশন।

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর