সাইফুল ইসলাম ::
ডিসেম্বরে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আন্দোলনে গতি ফেরানোর পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছে বিএনপি । বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশে লোক সমাগমের সুফল ঘরে তুলতে চায় বিএনপি। সুত্রমতে, সমমনা দলগুলোর সাথে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্তে নেবার পাশাপাশি বছরের মধ্যভাগ পর্যন্ত দ্রব্য মুল্যের উর্ধগতিসহ জনমুখী ইস্যুতে রাজপথে থাকার পরিকল্পনা সাজিয়েছে দলটির নীতি নির্ধারকরা।
গেল বছরের ডিসেম্বর মাসে সম্পন্ন হওয়া নয়টি মহাসমাবেশকে সফল দাবি করে বিএনপি নেতা বলছেন, মহানগর ও জেলা সদরে ‘গণমিছিল’ সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে তারা। এত দিন বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি এককভাবে পালন করে এলেও গণমিছিল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা হয়েছে৷
এরমধ্যে ৪টা ফেব্রুয়ারী তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ এর দামবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারাদেশের বিভাগীয় শহরে মহাসমাবেশ কোন বাধা ছাড়াই শেষ করেছে বিএনপি। বিএনপির নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকার পতন নয়, চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে আন্দোলন জোরদার করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন, ‘ সময়ের সাথে সাথে বিএনপি রাজপথে থেকে জণগণের ভোটের অধিকার ফেরত আনতে চায়। রাস্ট্রমেরামত করার ঘোষণাকে ভবিষ্যতের জন্য ছয় দফার মতো রাষ্ট্র রূপান্তর কর্মসূচিতে পরিণত করতে চায় ৷ গণ-অবস্থান, গণ-মিছিল এবং পদযাত্রা এসব কর্মসূচীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ১০ দফা দাবি আদায় করতে চায়। ‘
যদিও রাজপথে বিএনপি ‘গণঅভ্যুত্থান’ সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটাতে চাইছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে বিএনপির সেই ‘সক্ষমতাই’ নেই।ধারাবাহিকভাবে রাজপথে থাকলে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, সরকার পতনে বিএনপির আন্দোলনের জনসম্পৃক্ততার অভাবে বিএনপি আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। চলমান মহাসমাবেশের মতো কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে এমন দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তাঁর দাবি, আন্দোলন ব্যর্থ হলে বিএনপি আগুনসন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে, অতীতে তার প্রমাণ রয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও সন্ত্রাসের সে আশঙ্কা এখনো রয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে রাজপথ গরম রাখার কৌশল নিলেও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়কেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক সংকটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল নেয়া দলটির জন্য সামনের দিনগুলোতে জনদুর্ভোগ ও রাজনৈতিক অসন্তোষ শ্রীলঙ্কার মতো প্রচণ্ড গণবিক্ষোভে বিস্ফোরিত হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। দিন দিন নির্যাতিত-নিপীড়িত ও অভাবগ্রস্ত মানুষের সমর্থন বাড়ছে আন্দোলনরত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রতি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির গণসমাবেশগুলোতে বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢল নামছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সরকারের জন্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে এই গণবিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী মনে করেন , বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোর জণ্য আওয়ামী লীগ যেভাবে মাঠে নেমেছে তাতে এটা মনে হয় যে বিএনপির ‘জনসম্পৃক্ততা’ ধীরে ধীরে বাড়ছে।তবে দশদফার মতো কর্মসূচী দিয়ে সরকারকে বাধ্য করা খুব কঠিন।কারণ দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনিপকে এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যেখানে জনসম্পৃক্ততা বেশি। ‘
আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন আন্দোলনে এখন আর কোনো আগ্রহ নেই সাধারণ মানুষের । বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সঙ্কট, যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা পরিস্থিতি- সব মিলয়ে সাধারণ জনগণ এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে সাধারণ মানুষের এখন কোনো কৌতুহল নেই।
তবে গেল এক যুগে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা ইস্যুতে বিএনপি নানা কর্মসূচি দিয়েছে। কিন্তু প্রতিটি কর্মসূচিতে প্রাধান্য পেয়েছে দলীয় নেতাদের মামলা প্রত্যাহার, মুক্তি, জাতীয় নির্বাচনসহ দল সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো। আন্তর্জাতিক মহলেও দলের নেতাদের আলোচনায় দলীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে গুরুত্বের সঙ্গে সামনে এসেছে। কিন্তু গেল বছরের মাঝামাঝি সময়ে দলের স্বার্থের চেয়ে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য দেওয়ায় দলটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। জ্বালানি তেল ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে জনইস্যুতে গত জুলাই থেকে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। সারা দেশে জেলা, মহানগর, থানা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের এ কর্মসূচি পালন করে চলেছে দলটির নেতাকর্মীরা।
রাজনীতির মাঠে বিএনপির ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং বিপরীতমুখী বক্তব্য বিবৃতিকে স্বাভাবিক রাজনীতি হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন বিএনপির বর্তমান দশ দফার আন্দোলন কর্মসূচী দিয়ে যেমন ‘গণঅভ্যুত্থান’ সম্ভব নয় তেমনি দলটি যে একেবারেই ‘জনবিচ্ছিন্ন’ সেটিও ঠিক নয়। তবে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে লম্বা সময় চুপচাপ থেকে সংগঠন গুছিয়ে এখন জনসম্পৃক্ততার দিকে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। এটা নি:সন্দেহে একটা ইতিবাচক দিক।