27 C
Dhaka
Wednesday, February 12, 2025
More

    চসিকের দায়সারা ‘তদন্ত কমিটি’ দায়ীদের খুঁজে বের করবে!

    আরও পড়ুন

    খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ::

    চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানিকে মারধরের ঘটনায় চসিকের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন দেবার সময় শেষ হলেও রবিবার প্রতিবেদন জমা দেয় নি কমিটি। তদন্ত কমিটির কার্যক্রমও ঢিলেঢালা। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

    চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২৯ শে জানুয়ারি । কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন– সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তা মণীষা মহাজন এবং আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির। শুরুতে তিন দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও, পরে এক সপ্তাহ সময় দেয়া হয় । সেই সময়সীমা শেষ হয়েছে, সেই তদন্ত প্রতিবেদনের দেখা মিলেনি।

    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকৌশল বিভাগের দুজন প্রকৌশলী জানান, ‘ তদন্ত কমিটির পুরো বিষয়টি আইওয়াশ। প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানি যাতে চট্টগ্রামে না ফেরেন, সেজন্যই উপর মহলের ইশারায় হামলা হয়েছে৷ হামলার ঘটনায় চসিকের দায়ের করা মামলার তদন্ত ডিবি কাছে দেয়া হয়েছে।  চারজনকে গ্রেফতারের পর নতুন কাউকে গ্রেফতারই করা হয় নি। ‘

    সুত্রমতে, ‘ টাকার বিনিময়ে  ১৩ টি কাজের কার্যাদেশ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণেই প্রকল্প পরিচালকের উপর হামলা করে ঠিকাদারদের বিক্ষোভ হিসেবে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে একটি মহল। সেই মহলের ইশারায় ‘দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন’ দেয়া হবে -এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ঘটনার পর মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে ‘ তেমন কিছুই ঘটেনি’।

    সুত্রমতে, কাজ না পাবার কারনে ঠিকাদাররা প্রকল্প পরিচালকের উপর হামলা করেছে বলে বলা হলেও পরিকল্পিত এই হামলার ইন্দনদাতা চটপট সিটি করপোরেশনের পাঁচ কর্মকর্তা। চসিকের চারজন প্রকৌশলী এবং হিসাব বিভাগের এক কর্মকর্তা ঠিকাদারদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন ইয়াজদানিকে সরানোর জন্য৷ হামলার ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্য তৎপর ছিলো একই মহল । হামলার ঘটনায় গণমাধ্যম তৎপর হবার কারণে ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করতে হয়েছে৷ এছাড়া হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে অংশীদারত্বে ঠিকাদারী করছেন প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনসহ চসিকের ছয় প্রকৌশলী। এ বিষয়ে চসিক কার্যালয়ের সবাইই জানে৷ বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন তিনি।  ‘

    তদন্ত কমিটি সদস্যরা কবে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন সেই বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা,  সচিব কারো কাছ থেকেই কোন তথ্য মেলেনি। এছাড়া শনিবার কক্সবাজারে সমুদ্র বিলাসে ব্যস্ত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিমসহ সব শীর্ষ কর্মকর্তারা। রবিবার অফিসে দেখা মেলেনি অনেকের।

    চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নতুন মেয়র হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেবার  পর কিছু কর্মকর্তার নানা অনিয়ম-দুর্নীতির যেসব তথ্য বেরিয়ে আসে, তাতে মনে হতে পারে এ যেন অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটি বড় অংশ এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তাতে দেখা যায়, করপোরেশনের ফান্ডে টাকা না থাকলেও একশ্রেণির কর্মকর্তা করপোরেশনকে ব্যবহার করে টাকার কুমির বনে গেছেন। চসিকের বেশ কয়েকজন  প্রকৌশলীর সিটি করপোরেশনে  ঠিকাদারি করার বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হবার পর বিভিন্ন সময়ে লোক দেখানো  ‘তদন্ত কমিটি‘ গঠন করা হয়েছে, দূর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের ইশারায়  তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে অভিযুক্তদের। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার আশংকা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা৷

    চসিকের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, জাইকার অর্থায়নে চট্টগ্রাম নগরজুড়ে ডিজিটাল আলোকায়ন চার স্তরের সকল যন্ত্র ও লাইট ইউরোপের ভালো ব্র্যান্ডের সরবরাহ করার কথা বললেও মূলত সেসব জিনিস ভারত থেকে আনা হয়েছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কারসাজিতে এই অনিয়মের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেবার পরও চসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি৷

    জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে চলমান  চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) আওতাধীন ইনস্টলেশন অব জিআইপি পুল (বৈদ্যুতিক খুঁটি) অ্যান্ড এলইডি লাইট ওয়েরিং প্রকল্পের প্রায় ৪৮ কোটি টাকার কাজে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগ। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরজুড়ে ডিজিটাল আলোকায়ন চার স্তরের সকল যন্ত্র ও লাইট ইউরোপের ভালো ব্র্যান্ডের সরবরাহ করার কথা বললেও মূলত সেসব পণ্য ভারত থেকে আনা হয়েছে।

    এমনকি পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে এ প্রকল্পের প্রথম দরপত্র বাতিলও করা হয়েছিলো।  দ্বিতীয়বার দরপত্র দেওয়া হয় প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশের  পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে। পরে তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কাজে কারসাজি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে খোদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের এই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে।দুর্নীতির এসব ঘটনায় বারবার উঠে এসেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের নাম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, একের পর এক প্রকল্পে কারসাজির আশ্রয় নিয়ে তিনি পকেটে পুরেছেন কোটি কোটি টাকা।

    গণমাধ্যমে প্রকাশিত  তথ্যমতে, প্রকল্পের আওতায় নগরজুড়ে ডিজিটাল আলোকায়ন করতে লাগানো হয়েছে ৪০০ মিটার গ্যালভেনাইজড আয়রন (জিআই) পুল। স্থান ও এলাকার ধরন অনুসারে প্রতিটি পুল ৩০ মিটার উচ্চতার স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে প্রায় ২০০ মিটার পুল স্থাপন করা হয়েছে প্রতিটি মাত্র ২০ মিটার উচ্চতার।কিন্তু ৩০ মিটার উচ্চতার পুল দেখিয়ে কর্পোরেশন থেকে বিল তোলা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। সেই হিসেবে ১০ মিটার কম উচ্চতায় বানানো প্রতিটি পুলে টাকা বেচে যায় ১০ হাজার করে। এছাড়া ৪০০ মিটার জিআই পুলের স্থলে ২০০ মিটার পুল স্থাপন করা হচ্ছে। যেখানে প্রতিটি খুটিতে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে  ২ লাখ টাকা।  এসটিএমএস নামের একটি প্রতিষ্ঠান জালিয়াতি করে ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্যাডে ঘষামাজা করে অভিজ্ঞতার সনদ বানিয়ে সেই কাজ কৌশলে বাগিয়ে নেবার রাস্তা তৈরি করে দেন বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। সেই দূর্নীতি খোঁজে চসিকের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনকে উপহাস করে একই চক্রের কাছে ভারতীয় নমনীয় ঋন সুবিধার ২৬১ কোটি টাকার নতুন এলইডি প্রকল্পের কাজ দেবার বিষয়টি চুড়ান্ত করেছে প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ।

    পরিছন্ন বিভাগে নিয়মনীতি না মেনে শ্রমিক নিয়োগ, বেতনভাতার নামে লুটপাটের অভিযোগ  প্রমাণিত হয়েছিলো চসিকের আরেকটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। সেই তদন্ত কমিটি তদন্ত কমিটি ১১ দফা সুপারিশও উল্লেখ করেছিলো  । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশে বলা হয়— স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত দুই হাজার শ্রমিকের বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগের এখতিয়ার চসিকের নেই। অবিলম্বে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা দরকার। এছাড়া চসিকের সচিবালয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক শ্রমিকের ব্যক্তিগত নথি সংরক্ষণ করা ও ডাটাবেজ তৈরির কথা সুপারিশে বলা হয়েছে। মানা হয় নি সেসব সুপারিশও। গেল বছরের ২৯ শে ডিসেম্বর নতুন করে তিনজন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে উঠানো হয়েছে সড়ক পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতির তালিকায়। চট্টগ্রাম নগরীতে ‘ডোর টু ডোর’ ময়লা-আবর্জনা অপসারণের নামে বছরের পর বছর অবাধ লুটপাটের অভিযোগ হাওয়া হয়ে গেছে সাম্প্রতিক সময়ে ময়লা সংগ্রহকে ইজারা তুলে  পাইলট প্রকল্পের নামে ‘ময়লা বাণিজ্যের’ আড়ালে।

    করপোরেশনের সূত্রমতে, এভাবে বছরের পর বছর ধরে চলছে দুর্নীতি, লুটপাট। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ, মামলা, দুদকের নজরদারি, অভিযান- কোনোকিছুই দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রটিকে আটকাতে পারেনি। ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে, করপোরেশনকে যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে পরিচালিত করে লুটপাট চলেছে সমানে।

    গেল রোববার (২৯ জানুয়ারী)  বিকেল পৌনে ৪টার দিকে চসিকের টাইগার পাস অস্থায়ী কার্যালয়ে দুই হাজার ৩৯২ কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানীর কক্ষে হামলা করেন একই দূর্নীতিবাজ চক্রের সদস্যরা । এসময় তাকেও মারধর করেন চসিকের শীর্ষকর্তার  প্রশ্রয়ে থাকা প্রভাবশালী ঠিকাদাররা। এ ঘটনায় রাতে নগরের খুলশী থানায় চসিকের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর